সংবাদচর্চা রিপোর্ট:
নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্র চাষাঢ়ায় এমপি শামীম ওসমানকে টার্গেট করে আওয়ামী লীগ অফিসে বর্বরোচিত বোমা হামলার ১৯ বছর পূর্ণ হচ্ছে ১৬ জুন। চাঞ্চল্যকর এ বোমা হামলার ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলায় আদালতে চার্জশিট দেওয়া হলেও বিচার কাজ চলছে ঢিমেতালে। এখন চলছে সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণের কাজ। বিচারকার্যের দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন খোদ আওয়ামী লীগের এমপি শামীম ওসমান। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদের শেষদিকে ১৬ জুন চাষাঢ়া আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। রাত পৌনে ৮টার দিকে তখনকার এমপি শামীম ওসমান যখন জনগণের কথা শোনার জন্য সাক্ষাৎ দিচ্ছিলেন ঠিক তখনি বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। সেই হামলায় আওয়ামী লীগের ২০ জন নেতা-কর্মী প্রাণ হারান। গুরুতর আহত হন শামীম ওসমানসহ অর্ধশতাধিক লোক। চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির জেলার সভাপতি চন্দন শীল, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রতন দাসসহ অনেকেই। সে ঘটনায় সেদিনই নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোকন সাহা দুটি মামলা (একটি বিস্ফোরক ও অন্যটি হত্যা) দায়ের করেন। ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করেন। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে এ মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করা হয়। দুটি মামলায় ১৪ বছরে ৭ বার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন এবং ৮ম বার ১৩ বছর পর দুটি মামলায় ২০১৩ সালের ২ মে ৬ জনকে অভিযুক্ত ও ৩১ জনকে অব্যাহতি প্রদান করে নারায়ণগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দুটি মামলার প্রত্যেকটির ৯৪৭ পাতার চার্জশিট দাখিল করা হয়। এতে মামলার চার্জশিট থেকে তৈমূর আলম খন্দকারসহ ৩১ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
সেদিন যারা নিহত হয় :
বোমা বিস্ফোরণে মুহূর্তেই শরীর দেহ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় সেখানে উপস্থিত অসংখ্য ব্যক্তির। এদের মধ্যে একজন নারীর পরিচয় এখনও জানা যায়নি। নিহত অন্যরা হলেন, শহর ছাত্রলীগের সভাপতি সাইদুল হাসান বাপ্পী, সহোদর সরকারি তোলারাম কলেজ ছাত্র-ছাত্রী সংসদের জিএস আকতার হোসেন ও সঙ্গীত শিল্পী মোশাররফ হোসেন মশু, সঙ্গীত শিল্পী নজরুল ইসলাম বাচ্চু, ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগ যুগ্ম সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন ভাসানী, নারায়ণগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবিএম নজরুল ইসলাম, স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা সাইদুর রহমান সবুজ মোল্লা, মহিলা আওয়ামীলীগ নেত্রী পলি বেগম, ছাত্রলীগ কর্মী স্বপন দাস, কবি শওকত হোসেন মোক্তার, পান-সিগারেট বিক্রেতা হালিমা বেগম, সিদ্ধিরগঞ্জ ওয়ার্ড মেম্বার রাজিয়া বেগম, যুবলীগ কর্মী নিধু রাম বিশ্বাস, আব্দুস সাত্তার, আবু হানিফ, এনায়েত উল্লাহ স্বপন, আব্দুল আলীম, শুক্কুর আলী ও স্বপন রায়।
মামলায় গ্রেপ্তারকৃতরা :
২০০৫ সালের ১ অক্টোবর গ্রেপ্তার হয় হরকাতুল জেহাদের অন্যতম নেতা মুফতি আবদুল হান্নান। গ্রেপ্তারের পর তিনি র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার নিকট দেয়া জবানবন্দিতে চাষাঢ়া বোমা হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। ২০০৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ভারতের রাজধারী দিল্লির একটি রেল স্টেশন হতে হরকাতুল জিহাদের ২ জঙ্গি সহোদর আনিসুল মোরসালিন ও মুহিবুল মুত্তাকিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বাড়ি বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায়। তারাও বোমা হামলার ঘটনা স্বীকার করেছেন। দুইজনই বর্তমানে দিল্লি কারাগারে বন্দী রয়েছেন। বোমা হামলা মামলার বারো নাম্বার আসামি শাহাদাৎ উল্লাহ জুয়েল নারায়ণগঞ্জের শীর্ষ সন্ত্রাসী ক্রস ফায়ারে নিহত মমিনউল্লাহ ডেভিড ও পরিবহন সন্ত্রাসী মাহবুব উল্লাহ তপনের ছোট ভাই। ২০০৭ সালের ২৭ নভেম্বর শহরের মিশনপাড়ার বাসভবন থেকে জুয়েলকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-১১। জুয়েলের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ কার্যালয়ের সামনে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার অর্থ জোগান দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুকে চাষাঢ়া বোমা হামলা মামলায় গত বছরের ১০ নভেম্বর শ্যোন অ্যারেস্ট দেখায় সিআইডি। এছাড়া গ্রেপ্তার হয়েছেন ঢাকার ৫৩ নাম্বার ওয়ার্ড কমিশনার ও ঢাকা মহানগর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আরিফুর রহমান। তাদের কয়েক দফা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিআইডি।
এ প্রসঙ্গে পাবলিক প্রসিকিউটর ওয়াজেদ আলী খোকন জানান, ১৬ জুনের বোমা হামলার ঘটনায় ২ টি মামলা দায়ের করা হয়। মামলা আসামী ৬ জন। একজন আসামী অন্য মামলায় ফাঁসি হয়েছে। পিপি আরও বলেন, ২ মামলায় ইতিমধ্যে ১০ জন করে মোট ২০ জন সাক্ষী সাক্ষ প্রদান করেছেন। বাকি রয়েছে ১০ থেকে ১২ জন সাক্ষী। আগামী ৭ মাস সময় লাগবে সাক্ষ গ্রহনসহ বাকি ৩ টি প্রক্রিয়া শেষ করতে। পলাতক আসামীদের বিরুদ্ধেও চার্জ নেয়া হয়েছে।
১৬ জুন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারবর্গের আহ্বায়ক বোমা হামলায় দ্ইু পা হারানো চন্দন শীল জানান, কবে বিচার পাব জানিনা। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন তিনি যেন দ্রুত বিচার কাজ শেষ করতে ব্যবস্থা নেন। বিচার হলে তবেই নিহতদের আত্মা শান্তি পাবে।
বোমা হামলায় দুই পা হারানো রতন দাস বলেন, মামলাটি এখন সাক্ষী পর্যায়ে আছে। যদি মহামারী করোনা এর মধ্যে শেষ হয়ে যায় তাহলে আশা করি বিচার পাবো।
বোমা হামলায় আহত তৎকালীণ চাষাঢ়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সহ সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ লুৎফর রহমান সেদিনের ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, সেদিন রাত তখন ৮টা ৪৫ মিনিট। বিকট শব্দ। তারপর আমি আর কিছুই বলতে পারবো না। পরে জানতে পারি বোমা বিস্ফোরণের প্রায় ২০ মিনিট ওইখানেই পড়েছিলাম। আমার শরীর থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। সেদিন ২০টির বেশি স্প্রিন্টারের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। একেকটি স্প্রিন্টার যেন রাইফেলের একেকটি গুলির মতো। দুইদিন পর জ্ঞান ফিরে আসে। যখন জেগে উঠি তখন দেখি আমার ডান পার উপরের অংশ থেকে অনবরত রক্ত বের হচ্ছে। এরপর দীর্ঘ তিন মাস হাসপাতালে থাকতে হয়। শরীরে অসংখ্য স্প্রিন্টার নিয়ে এখনো বেঁচে আছি শুধু বিচার দেখে যেতে চাই বলে।
বোমা বিস্ফোরনের ঘটনার পর সে সময়ে মাসদাইরের বাড়ি থেকে সাংবাদিক সামসুল আলম লিটন কে জোর করে ধরে নিয়ে একদল সন্ত্রাসী পুলিশের হাতে তুলে দেয়। একইভাবে মাসদাইর বাজার এলাকা থেকে মিজান নামের এক বিএনপির কর্মীকে ধরে পুলিশে দেয়। এ ঘটনায় মামলা চলমান। তবে এরপরের অনেক ঘটনার বিচার কার্য শেষ হলেও বোমা বিস্ফোরনে ২০ হত্যা মামলার বিচারের স্বাক্ষগ্রহন পর্যায়ে রয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে বিচার কেন বিলম্ব হচ্ছে এমন প্রশ্ন ভুক্তভোগীদের। তাদের মতে, বিচার শেষ হলেই পরিস্কার হবে কে বা কারা বোমা ফাটালো।